Tuesday, 15 July 2025

স্বাধীনতার দ্বিতীয় অগ্নিযুগ



স্বাধীনতার দ্বিতীয় অগ্নিযুগ

আরমান রশিদ 

 

 [উক্ত দিনলিপি তে আমার নিজের চোখে দেখা ঘটনা, নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং ওন্যদের থেকে শুনতে পাওয়া ঘটনার তথ্যের মিশ্রণে তৈরি একটা ছোট গল্প]


📅 ১লা জুলাই, সোমবার:

আজ ক্লাসে গিয়ে আর মন বসাতে পারিনি। সকাল ১১টার দিকে ফেসবুকে খবর পেলামসরকার চাকরির কোটা পুনর্বহাল করেছে। মুক্তিযোদ্ধা ৩০%, নারী ১০%, আদিবাসী প্রতিবন্ধীদেরও কোটা। হঠাৎ যেন ২০১৮ নয়, ১৯৭১ ফিরে এলো। যুদ্ধে নয়, আমরা যাচ্ছি বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক লড়াইয়ে।

সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে মেইন গেটে গিয়ে দাঁড়ালাম। কেউ হাতে প্ল্যাকার্ড, কেউ গলায় বাঁধা কালো কাপড়। কেউ বলল— “মাঠে নামি ভাই, ফেসবুকে আর কত?”

আমরা নীরব মিছিল করলাম। কিন্তু বুকের ভেতর ছিল আগুন।

 

 

📅 ২রা জুলাই, মঙ্গলবার:

প্রধানমন্ত্রীর এক বক্তব্যে আমাদেররাজাকারের বংশধরবলা হলো। মাথা নত হয়ে আসলো না, মাথা উঁচু করে শপথ করলাম— “এই দেশের কেউ যদি মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়, তবে আমরাও শহীদের নাতি!”

আজকের মিছিলটা ছিল অন্যরকম। স্লোগান গর্জে উঠেছে:

চেয়েছিলাম অধিকার,

হয়ে গেলাম রাজাকার!”

প্রথমবার ছাত্রলীগ এসে লাঠি হাতে। তাদের চোখে ঘৃণা, আমাদের চোখে দৃঢ়তা।

আজ বুঝলামআন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। আর ফেরা নেই।

 

 

📅 ৩রা জুলাই, বুধবার:

রাতটা ছিল যুদ্ধের রাত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে হানা দিলো ছাত্রলীগের ক্যাডার বাহিনী। অনেকটা ৭১-এর ২৫শে মার্চের মতো, শুধু পোশাক আলাদা।

বন্ধু অনিকের ঘাড়ে লাঠির আঘাত, নীরার মোবাইল ছিনতাই করে ছবি ডিলিট করে দিয়েছে।

আকাশে হেলিকপ্টারের শব্দ নেই, তবুও মনে হচ্ছিল পাখি উড়ছে নাভয় পেয়েছে।

আমি আজ প্রথমবার রাস্তায় শুয়ে পড়া এক ছাত্রের গায়ে হাত রেখেছিলামসজীব নাম, গুলিবিদ্ধ। বলেছিল, “ভাই, আমার আম্মারে বলে দিওআমি দেশটা ভালোবেসে মরলাম।

 

 

📅 -- জুলাই:

পুরো বাংলাদেশ এখন রাজপথ।

NUB ব্লক করেছে শাহজালাল বিমানবন্দর,

NSU, IUB, AIUB ছড়িয়ে পড়েছে কুড়িল-মালিবাগ

ব্র্যাক-ইস্ট ওয়েস্ট মিছিল করেছে হাতিরঝিলে

বিমান চলাচল বন্ধ, সিগন্যাল অচল। মা বলেছিলবাবা, বিপদ হবে। আমি বলেছি৭১-এর বাবারা ভয় পেলে দেশ হতো না।

আজ প্রথম শহীদ হয়েছে আবু সাঈদ গুলির আওয়াজ এখনও কানে বাজছে।

 

 

📅 জুলাই, রোববার:

শুধু ছাত্ররা নয়, এবার অভিভাবকরা নামলেন রাস্তায়। এক মা মাথায় সাদা ওড়না বেঁধে বললেন— “আমার ছেলে যদি শহীদ হয়, আমি গর্বিত মা হব।

ছাত্রলীগ-প্রশাসন হামলা চালাল। মেয়েদের গায়ে হাত তুললভিডিও করে আপলোড দিচ্ছিলাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ডিলিট হয়ে গেল।

প্রশাসনের সামনেই নীলা নামের এক ছাত্রীকে টেনে নিয়ে গেল। ওর চিৎকারে আমরা দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনিহেঁটে হেঁটেই লাঠির আঘাত নিয়েছি।

ভয়ে না, সম্মানে।

 

 

📅 --১০ জুলাই:

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা। ছাত্রলীগ ক্যাম্পাস ছাড়ে না, কিন্তু সাধারণ ছাত্ররাই জায়গা দখল নেয়। গানের মতো গর্জে উঠলো

এই দেশ আমার, এই রাস্তা আমার,

যে নেবে কেড়ে, তার রক্ত আমার।

আজ আমি নিজ চোখে দেখেছি, ছাত্রলীগের দুই নেতা কাগজে সই করছেভবিষ্যতে রাজনীতিতে থাকবে না। হয়তো ওরাও বুঝে গেছেসময় বদলে গেছে।

 

 

📅 ১১-১২-১৩ জুলাই:

আমরা ঢুকেছি টেলিভিশন ভবনে। আগুন লেগে যায়। কেউ বললএটা উগ্রতা।

আমি বললাম— “৭১- টেলিফোন অফিসে আগুন দিয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধারা। কারণ তা দিয়ে শত্রু খবর পাঠাতো।

আজ আমরা আগুন দিয়েছি মিথ্যেকে।

মিরপুর থেকে সেনাবাহিনীর ট্যাংক নামছে। তারা সরকারকে রক্ষা করবে না, রক্ষা করবে শুধু নিজেরাসেটা বোঝা যাচ্ছে।

 

 

📅 ১৪-১৯ জুলাই:

সব বন্ধ:  ইন্টারনেট নেই, মোবাইল বন্ধ, পানি সংকট, আলো নেই

হলের ভেতর গুলির শব্দকেউ জানে না কতজন মরলো।

আমরা কয়জন?  কারা?  কেউ নাম রাখেনি। ঠিক যেমন ৭১-এর অনেক শহীদের নাম নেই।

 

 

📅 ২০-২৪ জুলাই:

১৪৪ ধারা জারি। রাস্তায় নামলেই গুলি।

সামরিক বাহিনী মোতায়েন, গুলি চললো ছাত্রদের মাথায়।

নিউ মার্কেটের পাশেই দেখেছিএকজন ছাত্র হাত তুলে বলেছে, “আমি কিছু করিনি”— তারপরও পড়ে গেল।

ওর পাশে দাঁড়ানো এক মহিলা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আমার ভাই ৭১- মরেছিল পাকিস্তানিদের হাতে, আর আমার ছেলে মরলো নিজের দেশের পুলিশের গুলিতে।

 

 

📅 ২৫-৩০ জুলাই:

যতদূর দৃষ্টি যায়, ততদূর লাশ।

স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে দেয়নি কেউ, কিন্তু আমরা নিজেরাই স্মৃতি হয়ে যাচ্ছি।

দেশের ভেতরে কেউ জানে না কী হচ্ছে, বাইরের দুনিয়া জানতেই পারছে না। সব মিডিয়া বন্ধ।

যেন ৭১-এর সেই সময়, যখন রেডিওতে খবর পেতাম, আর বাকিটা বিশ্বাস করতাম চোখে দেখা রক্তে।

 

 

📅 ৩১ জুলাই আগস্ট:

গায়েবানা জানাজা হয়।

আমার বন্ধু রাশেদের লাশ মেলে ধানমণ্ডির এক গলিতেওর জামা পুড়ে গেছে, হাতে ছিল ব্যানার।

বাবা বললেন— “তোর বন্ধুরা বেঁচে থাকবে ইতিহাসে।"

আমি বললাম— “বাবা, যদি বেঁচে ফিরি, আমি ওদের নাম লিখে রাখবো। যাতে আর কখনো কেউ ভুলে না যায়।

 

 

উপসংহার: 

এই দেশ আবার জেগেছে। নতুন এক মুক্তিযুদ্ধ, যেখানে শত্রু বাইরের কেউ নয়ভেতরের অন্যায়। আমরা কোটা সংস্কার চেয়েছিলাম, এখন চাই মানুষ চায়, সরকার বদলাক। এটা শুধু ছাত্রদের আন্দোলন নয়এটা আগামী প্রজন্মের স্বাধীনতার লড়াই।


0 comments: